মানুষের জীবনযাপনে দুই ধরনের সম্পদের প্রয়োজন হয়। এর একটি আমরা খুব সহজে বুঝতে পারি যেটি স্পর্শ করা যায়, যেমন বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা, জামা কিংবা খাবার। এগুলো মানুষের জাগতিক, তবে শুধু এসবেই মানুষ তৃপ্ত থাকে না। তাকে তার মানবিক গুণকেও লালন করতে হয়। সে গান শোনে, কবিতা আবৃত্তি করে, গবেষণা করে, সৃষ্টিশীল কাজ করে, নতুন নতুন পণ্য ও সেবা দিয়ে মানুষের জীবনকে সহজ করে। এসব বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের মাধ্যমেও সম্পদ সৃষ্টি হয় যাকে আমরা বলতে পারি বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ। মানুষ স্বভাবতই তার সব ধরনের সম্পদকে আঁকড়ে রাখতে চায়, রক্ষা করতে চায়। বস্তুজগতের সম্পত্তিগুলো এমন যে, কেউ চাইলেই সেটি নিয়ে যেতে পারে না, বা আরেকটা একই রকমভাবে বানাতে পারে না। কোনো লোক ইচ্ছে করলে কি আলাদিনের দৈত্যকে দিয়ে তোমার বাড়িটা তুলে নিয়ে যেতে পারবে? পারবে না। কারণ সেটি একদিকে সম্ভব নয় আবার অন্যদিকে আইনও সেটা করতে দেবে না। অথচ ধরো তুমি সুন্দর একটি গান লিখে সেটিতে সুর করলে। তারপর তোমার বন্ধুদের শোনালে। তখন তোমার বন্ধুদের একজন ইচ্ছে করলে সেটি অন্যদের কাছে নিজের গান বলে চালিয়ে দিতে পারে। আবার নিজের নামে দাবি না করলেও এমনকি তোমার অনুমতি ছাড়া সেটি সে বিভিন্ন স্থানে গাইতে পারে। তুমি একটা সুন্দর কবিতা লিখলে, সেটিও কেউ একজন তোমার অনুমতি ছাড়া কোথাও ছাপিয়ে দিতে পারে। এরকম যদি হয় তাহলে সেটি সমাজের জন্য সুন্দর হয় না। কারণ এর ফলে যারা সৃজনশীল কাজ করে তারা তাদের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি পায় না। এমনকি এর জন্য যদি তাদের কোনো আর্থিক লাভ হওয়ার কথাথাকে সেটাও হয় না। আমরা একটি গল্পের বইয়ের উদাহরণ থেকে এই ব্যাপারটি আরেকটু ভালো করে বুঝতে পারব। একজন লেখক তার শ্রম, সময় এবং চিন্তা দিয়ে বইটি লিখেন। এরপর একজন প্রকাশক বইটি প্রকাশ করেন। তিনি বাজার থেকে কাগজ কিনে, বইটি ছাপিয়ে, বাঁধাই করে, বিভিন্ন বিক্রেতার মাধ্যমে আমাদের কাছে পৌঁছে দেন। স্বভাবতই এ কাজে তার যে খরচ হয় সেটি ধরে নিয়ে তিনি বইয়ের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেন। এর মধ্যে একটি অংশ লেখক পান যাকে বলা হয় রয়্যালটি। এখন যদি কেউ লেখকের অজান্তে তার বই বের করে ফেলে তাহলে লেখক তার এই প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হন। কাজেই এমন একটা ব্যবস্থা থাকা দরকার, যেটি সৃজনশীল কর্মের যারা স্রষ্টা তাদের এই অধিকার অক্ষুণ্ণ বা বজায় রাখে। পৃথিবীর দেশে দেশে তাই সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের কপি বা পুনরুৎপাদন, অবৈধ ব্যবহার ইত্যাদি বন্ধের জন্য আইনের বিধান রাখা হয়। যেহেতু এই আইন কপি বা পুনরুৎপাদনের অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে তৈরি তাই এটিকে কপিরাইট (Copyright) আইন বা সংক্ষেপে কপিরাইট বলে।
মুদ্রণ যন্ত্র আবিষ্কার হওয়ার পর বই কপি করা বা নকল করাটা সহজ হয়ে গিয়েছে। লেখকদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সর্বপ্রথম যুক্তরাজ্যে ১৬৬২ সালে কপিরাইট আইন (Licensing of the Press Act 1662) পার্লামেন্টে পাস করে। এই আইনের আওতায় যারা তাদের বইয়ের অননুমোদিত কপি করা বন্ধ করতে চায় তারা তাদের বই রেজিস্ট্রেশন করে একটা লাইসেন্স নিত। বই দিয়ে সূচনা হলেও পরে দেখা যায় সৃজনশীল কর্মের অন্যান্য প্রকাশেরও সংরক্ষণ প্রয়োজন। তখন বিভিন্ন আবিষ্কার, ব্যবসার মার্কা ইত্যাদিও বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ বা মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের আওতায় চলে আসে। কম্পিউটার আবিষ্কারের পর দেখা গেল বই, ছবি বা অনুরূপ কর্মের পুনরুৎপাদন খুবই সহজ। আর ইন্টারনেটের আবিষ্কারের পর দেখা গেল তা সারা দুনিয়াতেই ছড়িয়ে দেওয়া যায়। কাজেই কম্পিউটারের মাধ্যমে পুনরুৎপাদন এবং বিতরণও এখন এই আইনের আওতায় চলে এসেছে। একই সঙ্গে কম্পিউটারের প্রোগ্রামও যেহেতু একটি সৃজনশীল কর্মকান্ড, তাই এই আইনের আওতায় এর স্রষ্টা তার অধিকার সংরক্ষণ করতে পারেন। বর্তমানে যেসব দেশে এই আইন আছে সেসব দেশে সৃজনশীল কাজের কপিরাইট স্রষ্টার মৃত্যুর পরও বলবৎ থাকে। এটি কোনো কোনো দেশে এমনকি ১০০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। তবে সাধারণত এটি লেখক, শিল্পী, নাট্যকারের মৃত্যুর পর ৫০ থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত বলবৎ থাকে। বাংলাদেশের কপিরাইট আইনে (কপিরাইট আইন ২০০০) এর মেয়াদ ৬০ বছর। যখন কোনো সৃজনশীল কর্মের কপিরাইট ভঙ্গ করে সেটি পুনরুৎপাদন করা হয় তখন সেটিকে বলা হয় চোরাই (Pirated) কপি। যেহেতু কম্পিউটারের বিষয়গুলো সহজে কপি করা যায় তাই এগুলোর চোরাই কপি পাওয়া যায় সবচেয়ে বেশি। কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় আমাদের এই বিষয়টি সব সময় খেয়াল রাখতে হয়। আমরা যখন কাউকে কোনো কিছু কম্পিউটার থেকে কপি করে দেব তখন যেন কপিরাইট আইন ভঙ্গ না করি। শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা গেমস নয়, আমাদের কম্পিউটারে অনেক সময় অনেক ছবি থাকে, অনেকের গল্প-কবিতাও থাকে। আমরা যখন কাউকে সেটা কপি করে দেব তখন আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের কিন্তু সেগুলো কপি করে অন্যকে দেওয়ার অধিকার নেই। তবে সৃজনশীল কর্ম ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু কিছু স্বাধীনতাও থাকে। বিশেষ করে, একাডেমিক বা পড়ালেখার কাজে সৃজনশীল কাজ কপি করা যায়। পড়ালেখার কাজে আমরা কোনো বইয়ের যে ফটোকপি করি, তা কপিরাইট আইন ভঙ্গ করে না। এরকম ব্যবহারকে বলা হয় 'ফেয়ার ইউজ'।
কপিরাইটের এই সংরক্ষণবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি ভিন্নধর্মী ধারণাও বর্তমানে বেশ চালু হয়েছে। এর মূল কথা হলো কোনো লেখক, শিল্পী, প্রোগ্রামার বা নাট্যকার ইচ্ছে করলে তার সৃষ্ট সৃজনশীল কর্মকে শর্তসাপেক্ষে কপি করার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারেন। এই দর্শনকে বলা হয় মুক্ত দর্শন বা ওপেন সোর্স ফিলসফি (Open Source Philosophy)। যারা এই দর্শনের অনুসারী তারা তাদের সৃজনশীল কর্মকে কয়েকটি লাইসেন্সের মাধ্যমে সবাইকে ব্যবহার করতে দেন। এর মধ্যে কপিরাইটের একেবারে উল্টোটি হলো কপিলেফট (Copyleft)। যার অর্থ সৃজনশীল কর্মের স্রষ্টা সবাইকে এই কাজ কপি করার সানন্দ অনুমতি দিয়ে দিচ্ছেন। কপিরাইট আর কপিলেফটের মাঝখানে রয়েছে সৃজনী সাধারণ বা ক্রিয়েটিভ কমন্স (Creative Commons)। সৃজনী সাধারণ লাইসেন্সের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কর্মস্রষ্টার কিছু কিছু অধিকার সংরক্ষিত হয়ে থাকে। যেমন-যে কেউ ইচ্ছে করলে লেখকের বই তার লিখিত বা কোনো আইনি অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ করতে পারবে। তবে লেখকের নামে প্রকাশ করতে হবে বা সেটি দিয়ে কোনো মুনাফা লাভ করা যাবে না। মুক্ত দর্শনের আওতায় যে কম্পিউটার সফটওয়্যারগুলো প্রকাশিত হয় সেগুলোকে একত্রে মুক্ত সফটওয়্যার বা ওপেন সোর্স সফটওয়্যার (Open Source Software) বলা হয়। এই সফটওয়্যারগুলো সহজে একজন অন্যজনকে কপি করে দিতে পারে, ব্যবহারও করতে পারে। তবে যেহেতু সবাই কপি এবং পরিবর্তন করতে পারে তাই সারাবিশ্বের লোকেরা মিলে এই সফটওয়্যারগুলোকে খুবই শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলে। এই দর্শনের আর একটি বড় প্রকাশ হলো মুক্ত জ্ঞানভান্ডার উইকিপিডিয়া (www.wikipedia.org)। সবাই মিলে ইন্টারনেটে এই মুক্ত জ্ঞানকোষ গড়ে তুলেছে কয়েকটি মুক্ত লাইসেন্সের আওতায়।
দলগত কাজ মুক্ত দর্শনের পক্ষে এবং বিপক্ষে দুটি দল তৈরি করে শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে একটি বিতর্কের আয়োজন করো . |
common.read_more